সোমবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

সংগ্রামী ইতিহাস নিয়ে রমরমিয়ে চলছে মধুচক্র বিদ্যালয়

সংগ্রামী ইতিহাস নিয়ে রমরমিয়ে চলছে মধুচক্র বিদ্যালয়




Soumen Sil চুঁচুড়া, Tuesday, 09 February 2016

সৌমেন শীল: স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস নিয়ে রমরমিয়ে চলেছে মধুচক্র বিদ্যালয়। শেরশাহের নির্মিত চট্টগ্রাম থেকে কাবুল পর্যন্ত দীর্ঘ রাস্তা গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের উপরেই স্বমহিমায় দণ্ডায়মান এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শিক্ষক-শিক্ষিকারা কিঞ্চিৎ লজ্জিত হলেও বিদ্যালয় নিয়ে গর্বিত স্থানীয়রা। দীর্ঘদিনের অনেক ইতিহাস জড়িয়ে আছে এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে।
১৯৫১ সালে যাত্রা শুরু করে হুগলি জেলার বৈদ্যবাটির মধুচক্র প্রাথমিক বিদ্যালয়। শ্রীরামপুর থানা এলাকায় বৈদ্যবাটি রেল স্টেশনের কাছেই অবস্থিত এই স্কুল। কিন্তু, স্কুলের নাম মধুচক্র প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন? এই প্রশ্নের সঠিক উত্তর জানা নেই স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের। স্কুলে একাধিক শিক্ষক থাকলেও, শিক্ষিকা মাত্র একজনই৷তাঁর মতে, "কী কারণে এমন নাম তা অনেক চেষ্টা করেও জানতে পারিনি। স্কুলের নাম বদলের কথাও বলেছিলাম।" স্কুলের নামটা তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে অনেক প্রভাব ফেলছে বলেও জানালেন ওই শিক্ষিকা। অন্য এক শিক্ষকের কথায়, "এই স্কুল যখন তৈরি হয়, হতে পারে সেই সময় মধুচক্রের সংজ্ঞা এখনকার মতো ছিল না।" তবে নামরহস্য কিছুটা হলেও ফাঁস হল স্কুলের প্রধান শিক্ষক স্বপন মিত্র এবং প্রবীণ শিক্ষক জয়ন্ত হালদারের বয়ানে৷ তাঁদের থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, স্কুলটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস। সশস্ত্র ব্রিটিশ-বিরোধী সংগঠন অনুশীলন সমিতির কলকাতা কেন্দ্রের একটি শাখা ছিল এই স্কুলবাড়িতে। স্বাধীনতার আগে এই স্কুলে রাত্রে পঠনপাঠন চলত। আসলে রাতের অন্ধকারে নিজেদের বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড চালাতেন অনুশীলন সমিতির সদস্যরা। পুলিশের চোখে ধুলো দিতে ওঁদের দলটির নাম দেওয়া হয়েছিল 'মধুচক্র'। সেই থেকেই পরবর্তীকালে স্কুলের নামকরণ হয় মধুচক্র প্রাথমিক বিদ্যালয়। স্কুলের এহেন নামের পরিবর্তনের বিষয়ে প্রধান শিক্ষকের বক্তব্য, "ভুলেও ওই কাজটি করা যাবে না। স্থানীয় মানুষদের অনেক স্মৃতি আর আবেগ জড়িয়ে আছে এই স্কুলের সঙ্গে, আগুন জ্বলে যাবে।" একইসঙ্গে তাঁর দাবি, "স্কুলের নাম পালটানো এক জটিল ও বিশাল প্রক্রিয়া।"
মধুচক্র প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জন্মলগ্ন থেকেই এই স্কুলের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তি সনৎ বসু। তাঁর বক্তব্যে উঠে এল একটু অন্যরকম তথ্য। স্কুল পরিচালন কমিটির প্রবীণ সদস্য সনৎবাবু তুলে ধরলেন স্কুলের অন্য ইতিহাস। তাঁর কথায়, "১৯৪৩-৪৪ সাল নাগাদ এই এলাকায় ম্যালেরিয়ার প্রকোপ দেখা দিয়েছিল। সেই সময় অনেকে এখান থেকে বেনারস চলে যায়। সেখানে তাঁরা একটা সমিতি গঠন করেছিলেন, যার নাম ছিল 'মধুচক্র'। তাঁরা ফিরে এলেও সক্রিয় ছিল 'মধুচক্র সমিতি'। এখানে বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজকর্ম শুরু করে সেই 'মধুচক্র সমিতি'। রাত্রে পঠন পাঠনের জন্য তারাই তৈরি করেছিল 'মধুচক্র নৈশ প্রাথমিক বিদ্যালয়।' স্কুলের আড়ালে ব্রিটিশ বিরোধী বৈপ্লবিক কাজকর্ম চললেও তার ব্যাপকতা খুব বেশি ছিল না।" তবে সেই বিপ্লবীদলের সঙ্গে অনুশীলন সমিতির সদস্যদের কোনও যোগসূত্র ছিল কি না তা নির্দিষ্ট করে বলতে পারেননি তিনি। তাঁর মতে, "বিপ্লবীদের সক্রিয়তা খুব বেশি না থাকলেও ব্রিটিশ বাহিনীর আক্রমণের শিকার হয়েছিল বৈদ্যবাটির 'মধুচক্র সমিতি'। চিত্তরঞ্জন সেনগুপ্ত নামের একজন বিপ্লবী ব্রিটিশ পুলিশকর্মীর গুলিতে জখম হয়েছিলেন। যদিও তিনি এখন আর ইহলোকে নেই।" স্বাধীনতা আন্দোলনের ওই বিপ্লবীদলের একমাত্র জীবিত সদস্য প্রফুল্ল চক্রবর্তী স্কুলের কাছেই থাকেন। বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার কারণে তিনি এখন আর কথা বলার মতো অবস্থায় নেই।
স্বাধীনতার পর ১৯৫১ সালে স্থানীয়দের উদ্যোগে ফের চালু হয় মধুচক্র প্রাথমিক বিদ্যালয়। রাতে নয়, দিনেই চলতে থাকে পঠনপাঠন। দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর ১৯৫৭ সালে মেলে সরকারি অনুমোদন। তখন থেকে মসৃণভাবে চলছে এই স্কুল। ২০০৭ সালে পঞ্চাশ বছর উপলক্ষে স্কুলের 'সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষ' পালন করা হয়েছিল বলেও জানালেন সনৎ বসু।

Last Update: Wednesday, 17 February 2016, 03.56 IST      

কোন মন্তব্য নেই: